ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

রপ্তানি আয়ে অস্থিরতা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬ বার


 রপ্তানি আয়ে অস্থিরতা

অর্থনীতি এখন অনেক ‘ঝুঁকির’ চক্রে। দীর্ঘদিনের মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমলেও ব্যাবসায়িক আস্থা দুর্বল, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, ব্যাংকিং খাত রয়ে গেছে ভঙ্গুর অবস্থায়-সব মিলিয়ে অর্থনীতির পূর্ণ পুনরুদ্ধারে অনিশ্চয়তা প্রকট। আবার সামনে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচনী ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা পণ্য বাজারে নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে অনেকগুলো ‘যদি-কিংবা-কিন্তুর’ ওপর।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) নভেম্বর মাসের ইকোনমিক আপডেট পর্যালোচনা করলে এমন চিত্রই ধরা পড়ে।

ইকোনমিক আপডেটে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক গতি ফিরে আসা আগামী নির্বাচনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে।

ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন যদি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে এবং এর পাশাপাশি আগামী সরকার যদি সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায়, বিশেষ করে ব্যাবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, জ্বালানি ও রাজস্ব খাতের স্থিতিশীলতা যদি রক্ষা করতে পারে, তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতি আবারও পুনরুদ্ধার হতে পারে।

আউটলুকে বলা হয়, বাংলাদেশ যখন ২০২৬ সালে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন দেশের অর্থনৈতিক চিত্র নিয়ে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।

তবে এ জন্য নির্ভর করতে হবে অনেক কিছুর ওপর। বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পেছনে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন মূল্যস্ফীতি, দুর্বল ব্যাবসায়িক আস্থা এবং ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বেসরকারি বিনিয়োগকে সীমিত করে দিতে পারে। অনেক বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগ করার আগে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার জন্য ‘অপেক্ষা’ করে আছেন।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত অক্টোবর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে-৮.১৭ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের ১০.৮৭ শতাংশের তুলনায় কিছুটা কম। ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি কয়েক মাস ধরে শক্ত অবস্থানে থাকলেও ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ স্থবির। আগস্টে বছরের সর্বোচ্চ ১০.০২ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও সেপ্টেম্বরের হার কমে ৯.৯৮ শতাংশে আসে, যা এখনো স্থিতি নির্দেশ করে।

উচ্চ সুদহার, ব্যাংকগুলোর সতর্ক ঋণনীতি, দুর্বল বিনিয়োগ মনোভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ স্থবিরতার মূল কারণ। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশে। উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া, সরকারি সিকিউরিটিজে কম মুনাফা এবং রাজস্ব ঘাটতি সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারের নির্ভরতা আরো বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ধারাবাহিক সরকারি ঋণগ্রহণ বেসরকারি খাতকে ‘ক্রাউড-আউট’ করছে।

সুদের হারের স্প্রেডেও পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্প্রেড তুলনামূলক স্থিতিশীল, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্প্রেডও ৫.৫৫ শতাংশ থেকে ৫.৬৮ শতাংশের মধ্যে সীমিত উঠানামা করেছে। উচ্চ স্প্রেড, এনপিএল এবং অপচয়জনিত ব্যয় বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে আরো বাধাগ্রস্ত করছে।

রাজস্ব সংগ্রহের চিত্রও উদ্বেগজনক। অক্টোবর ২০২৫-এ এনবিআর তিন উৎস থেকে সংগ্রহ করেছে ২৮ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, যা মাসিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আট হাজার ৩২৪ কোটি টাকা কম। এডিপি বাস্তবায়নেও ধীরগতি স্পষ্ট। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাস্তবায়ন বেড়ে ৮.৩৩ শতাংশে পৌঁছালেও বরাদ্দ কমে যাওয়ার কারণে এই প্রবৃদ্ধিকে প্রকৃত উন্নতি বলা যাচ্ছে না; বরং প্রকল্প শুরুর বিলম্ব, তহবিল ছাড়ে জটিলতা এবং বাস্তবায়ন সক্ষমতার দুর্বলতা আগের মতোই বহাল রয়েছে।

বহির্বাণিজ্যে মিশ্র প্রবণতা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ সামগ্রিক বাহ্যিক খাতকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। নভেম্বর ২০২৪ থেকে অক্টোবর ২০২৫, এই সময়ে রিজার্ভ বেড়ে ২৪.৩৫ বিলিয়ন থেকে ৩২.৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রপ্তানি আয়ে ওঠানামা স্পষ্ট। জুন ও এপ্রিল ২০২৫-এ বড় পতন দেখা গেলেও জুলাইয়ের শিখরে ওঠার পর ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। অক্টোবরে আয়ের পরিমাণ ৩.৮২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ভালো হলেও বছরের সর্বোচ্চ থেকে অনেক কম। বিনিয়োগের অন্যতম সূচক ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি তীব্রভাবে কমেছে, জুলাই মাসে আমদানি নেমে এসেছে ২৬৭ মিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় বড় পতন।

মূল্যস্ফীতি কমছে এবং রেমিট্যান্স-রিজার্ভ খাত শক্তিশালী থাকলেও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বিনিয়োগ সংকট, ব্যাংকিং অস্থিরতা, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ওঠানামার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নির্বাচন একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক নির্দেশনা দিলে এবং নতুন সরকার ব্যবসাবান্ধব সংস্কার-বিশেষত ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, আর্থিক শৃঙ্খলা, শক্তির নিরাপত্তা এবং রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ দ্রুত পুনরুদ্ধারের গতিতে ফিরতে পারে। অন্যথায় অনিশ্চয়তার ছায়া আরো দীর্ঘ হবে।

ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া তারা নতুন সিদ্ধান্তে যেতে পারছেন না। অনেকেই অপেক্ষা করছেন নির্বাচন-পরবর্তী প্রবাহ, নীতি ও ব্যাবসায়িক পরিবেশ কী হবে তা দেখার জন্য। ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, ঋণখেলাপি বৃদ্ধি এবং ডলারের কৃত্রিম সংকট পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। ফলে সুদহার স্থির থাকা সত্ত্বেও ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা বিনিয়োগ মন্থরতার আরেকটি বড় কারণ।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের চরম দুরবস্থা দেখেও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ২০২২ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে ক্ষুদ্রশিল্পের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প খাত এই মুহূর্তে অত্যন্ত চাপে আছে, উচ্চ সুদ, মুদ্রাস্ফীতি ও শক্তি সংকট একসঙ্গে কাজ করছে। ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও চাপ পড়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে, শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ও শিল্প ক্ষেত্রকে বৈচিত্র্যময় করতে সরকারকে আরো উদারনীতি গ্রহণ করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি ও রাজনীতি পাশাপাশি চলে, একে অপরের পরিপূরক। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যত দীর্ঘ হবে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি তত বাড়বে।


   আরও সংবাদ