ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১১:৪০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৩ বার
ঢাকা: প্রবাদ আছে- রাজনীতিতে সময় সবকিছুর উত্তর দিয়ে দেয়! এক-এগারোর ঝড়ো পটপরিবর্তনের সময় যে মানুষটিকে রাজনৈতিকভাবে ‘মাইনাস’ করতে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, যাকে নির্যাতন, কারাবাস ও নির্বাসনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির প্রান্তে ঠেলে দিতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি আজ দেশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় বিএনপির একক নেতৃত্বের শীর্ষে।
২০ নভেম্বর ৬০ বছরে পা রাখতে যাওয়া তারেক রহমান সেই সব বিতর্ক, মিথ ও প্রচারণা পেরিয়ে উঠে এসেছেন নতুন এক রাজনৈতিক পরিণতির জায়গায়- যেখানে তার বক্তব্য, আচরণ ও সিদ্ধান্ত আজ তাকে জাতীয় নেতার সংজ্ঞায় পুনর্নির্মাণ করছে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সে সময় দেশের রাজনীতি থেকে দুই প্রধান নেত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার যে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বা বিরাজনীতীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তারেক রহমান। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রিমান্ডে থাকাকালীন তার ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, যার ফলে তিনি মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পান। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে চলে যান। বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন ছিল, তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। তবে গত ১৭ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করে দলের হাল ধরে রাখার মাধ্যমে সেই ‘মুচলেকা’র তত্ত্বটি অসার প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তৈরি করা হয়েছিল বিতর্কের পাহাড়। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার এবং সুশীল সমাজের একটি প্রভাবশালী অংশ অভিযোগ করতো যে, তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর ‘হাওয়া ভবন’ ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরে ‘ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র’ বা প্যারালাল গভর্নমেন্ট।
রাষ্ট্রীয় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলি-নিয়োগ বাণিজ্য এবং কথিত ‘টেন পারসেন্ট কমিশন’ সংস্কৃতির হোতা হিসেবে তাকে অপবাদ দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছিল। কথিত ‘খাম্বা দুর্নীতি’র অপতথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীরা।
তবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অভিযোগটি আনা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকে কেন্দ্র করে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় এবং পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সম্পূরক চার্জশিটের মাধ্যমে মুফতি হান্নানের ‘জবানবন্দির ভিত্তিতে’ তাকে এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারি মিডিয়া এবং পাঠ্যপুস্তকে এই অভিযোগগুলো এমনভাবে প্রচার করা হয় যে, জনমানসে তারেক রহমান সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ‘করাপশন ও ভায়োলেন্স’-এর ইমেজ বা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠ উন্মোচিত হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর। বর্তমান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে স্বাধীন বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দায়ের করা সব কয়টি মামলা থেকেই উচ্চ আদালত তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। সাম্প্রতিক রায়ে উচ্চ আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে, ২১ আগস্টের মতো জঘন্য ঘটনায় তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছিল কোনো দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই, মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং জোরপূর্বক আদায় করা জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে।
তথাকথিত ‘খাম্বা দুর্নীতি’ বা বিদেশে অর্থপাচার নিয়েও বিগত ১৭ বছরে কোনো কংক্রিট প্রমাণ আদালতে টেকেনি। আইন ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, আদালতের এই রায়গুলো তারেক রহমানের ওপর থেকে দীর্ঘদিনের ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মিত কলঙ্ক’ মোচনে আইনি ভিত্তি দিয়েছে, যা প্রমাণ করে যে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ছিল মূলত বিরাজনীতীকরণের ছক, যা আজ আইনিভাবে অসার প্রমাণিত হওয়ায় তার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের পথ সুগম হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারেক রহমান ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে নতুনভাবে উপস্থিত হয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে দীর্ঘদিন আইনি নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের গণমাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বোদ্ধারা তারেক রহমানের বক্তব্যে এবং আচরণে গুণগত পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করছেন।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ১৭ বছর আগের তারেক রহমান এবং বর্তমানের তারেক রহমানের মধ্যে বিস্তর তফাৎ লক্ষণীয়। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার এবং দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে তার মধ্যে ধীরতা ও রাজনৈতিক পরিপক্কতার ছাপ দেখছেন অনেকে। এসব বক্তব্য প্রশংসিত হচ্ছে সমালোচকদের কাছ থেকেও।
এছাড়া জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে তারেক রহমান শুরু থেকেই অত্যন্ত বিনয়ী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি এই বিজয়ের কৃতিত্ব কোনো রাজনৈতিক দলকে না দিয়ে বারবার শিক্ষার্থীদের এবং সাধারণ জনতাকে দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে বারবারই বলেছেন, ‘এই বিজয় কোনো নির্দিষ্ট দলের নয়, এই বিজয় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন বাংলাদেশকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।’
গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কোনো একক দলের দাবি না করে তিনি যেভাবে ছাত্র-জনতাকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তা তার উদারতার পরিচায়ক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার হাতবদল নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আন্দোলনের কৃতিত্ব একচ্ছত্রভাবে নিজের দলের দাবি না করে তিনি তরুণ প্রজন্মের মন জয় করার এবং নিজেকে ‘ইনক্লুসিভ’ নেতা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ৫ আগস্ট-পরবর্তী উত্তাল সময়ে তারেক রহমান প্রদর্শন করেছেন এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে যখন ক্ষমতার শূন্যতা ও সম্ভাব্য অরাজকতার শঙ্কা ছিল, তখন তিনি চিরাচরিত ‘প্রতিশোধের রাজনীতি’কে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন। তিনি নেতাকর্মীদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সতর্ক করে বলেছেন, ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; তাই আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সেই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া যাবে না।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার পরিবর্তনের পর যে প্রতিহিংসা, লুটপাট বা দখলদারিত্বের নেতিবাচক সংস্কৃতি দেখা যায়, এবার তারেক রহমানের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে তার উল্লেখযোগ্য ব্যত্যয় ঘটেছে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক বহিষ্কারাদেশ এবং কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, দলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ। এই সংকটকালে তার এমন দায়িত্বশীল ও কঠোর ভূমিকা বিএনপি নেতাকর্মীদের সংযত রাখতে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, যা তার নেতৃত্বের সক্ষমতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ।
সম্প্রতি তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশলের অন্যতম দিক হলো ‘জাতীয় ঐক্য’কে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকানোর প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড় করানো। তিনি গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে অনুধাবন করেছেন, দৃশ্যত স্বৈরাচারের পতন হলেও তাদের শেকড় অনেক গভীরে এবং তারা ‘প্রতিবিপ্লব’ ঘটানোর সুযোগ খুঁজছে। তাই তিনি বারবার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো স্বার্থ বা মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে ফাটল ধরলে, সেই সুযোগে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে; স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা আমাদের বিভেদের অপেক্ষায় ওৎ পেতে আছে।’
বিশেষ করে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এবং সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের রসায়ন বজায় রাখার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রকাশ্য কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে বা নির্দিষ্ট কোনো দলের নাম উল্লেখ না করেই তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, উগ্রবাদ বা সংকীর্ণতা নয়, বরং ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হবে। ভিন্নমতকে ‘শত্রু’ জ্ঞান না করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার যে সংস্কৃতি তিনি চালু করতে চাচ্ছেন, তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক নতুন দৃষ্টান্ত। বিভাজিত রাজনীতিতে তার ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ দর্শনটি এখন দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে।
দলকে সনাতন ধারার রাজনীতি থেকে বের করে আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের ক্ষেত্রে তারেক রহমান এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছ, বৈজ্ঞানিক এবং কাঠামোগত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত। দলীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তিনি এবার গতানুগতিক ‘লবিং ও টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন’ প্রথাকে পুরোপুরি বাতিল করে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্তরের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা ‘ছাঁকনি’ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন।
এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় কর্মী ও সমর্থকদের গোপন ভোটের মাধ্যমে পছন্দের তালিকা তৈরির পাশাপাশি একাধিক নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাই, বিগত ১৭ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগ ও রাজপথে থাকার ইতিহাস মূল্যায়ন এবং দুর্নীতি বা দখলদারিত্বমুক্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। সবশেষে দলের হাইকমান্ডের নিজস্ব পর্যালোচনা এবং প্রার্থীদের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার এই প্রক্রিয়ায় তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, লবিং বা অর্থের দাপটে নয়, এখন যোগ্যতা ও ত্যাগই একমাত্র মাপকাঠি।
এছাড়া ৫ আগস্টের পর দলের নাম ভাঙিয়ে যারা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন, যা দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রেখেছে। স্বৈরাচার পতনের পর দেশে যখন প্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থায় এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল, তখন এক শ্রেণির সুবিধাবাদী ও দলের নামধারী দুর্বৃত্তরা দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দলের ভেতরে ও বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘জনগণের ভীতি বা আতঙ্কের কারণ না হয়ে, জনগণের আস্থার প্রতীক হতে হবে। ভীতি প্রদর্শন করে নয়, যুক্তি দিয়ে মানুষের মন জয় করুন।’
বিএনপির দলীয় নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশে গত এক বছরে সারা দেশে দলের বিভিন্ন স্তরের শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও পদাবনতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মকারীদের বিষয়ে তিনি দ্ব্যর্থহীন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো অপকর্ম করলে, সে যেই হোক, তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। বিএনপি পরিবার কোনো অন্যায়কারী বা দুষ্কৃতকারীকে প্রশ্রয় দেবে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি দলের তৃণমূল কর্মীরা যখন ‘ক্ষমতার স্বাদ’ পেতে উন্মুখ, তখন দলের লাগাম টেনে ধরা কঠিন। কিন্তু তারেক রহমান অত্যন্ত কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘এই বিজয় ছাত্র-জনতার। হাজারো শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে অর্জিত, এই বিজয়কে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ ক্ষেত্রেও তারেক রহমান দেখিয়েছেন অসামান্য কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। তিনি অন্ধ ভারত-বিরোধিতা যেমন করেননি, তেমনি জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে নতজানু পররাষ্ট্রনীতিতেও বিশ্বাসী নন। সম্প্রতি ভারত প্রসঙ্গে তিনি বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি সবার আগে বাংলাদেশের স্বার্থ দেখবেন। তিনি পানির হিস্যা চান এবং তিনি সীমান্তের কাঁটাতারে আরেক ফেলানী ঝুলে আছে তা দেখতে চান না। তিনি মানুষের হিস্যা ও হিসাব চান।
শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ভারত যদি স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয় তো তার কিছু করার নেই৷ বাংলাদেশের মানুষের সিদ্ধান্ত, শীতল সম্পর্ক থাকবে, তাকে মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। তার এই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলেও তাকে একজন গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
তারেক রহমান কেবল রাজনীতির কথাই বলছেন না, তিনি বলছেন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা। রাষ্ট্রকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে তারেক রহমান ঘোষণা করেছেন ‘রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা’ রূপরেখা, যার মূল দর্শনই হলো জনকল্যাণ ও মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। এই পরিকল্পনায় তিনি ‘রেইনবো নেশন’ গঠনের ডাক দিয়েছেন, যেখানে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
তার রূপরেখায় কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণ এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যখাতে ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কার্ড’ চালু করে সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ‘বেকার ভাতা’ প্রদানের প্রতিশ্রুতি তার আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন। একই সঙ্গে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাবনার মাধ্যমে তিনি এমন এক জবাবদিহিতামূলক কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যা গতানুগতিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে তাকে একজন ‘ভিশনারি’ নেতা হিসেবে উপস্থাপন করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমানের রাজনৈতিক সত্তায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গভীর দেশপ্রেম এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন চেতনার এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটেছে, যা তাকে গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। তিনি মায়ের মতোই গণতন্ত্রের প্রশ্নে অবিচল থাকার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে তিনি কেবল পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলানো এবং সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করে তিনি বাবা-মায়ের ছায়া ছাপিয়ে এক ‘স্বতন্ত্র ও আধুনিক তারেক রহমান’-এ পরিণত হয়েছেন।
তারেক রহমানের রাজনীতির ভিত্তি শহীদ জিয়াউর রহমান ও আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার হলেও, তার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো পারিবারিক ট্র্যাজেডিকে কখনোই রাজনৈতিক পণ্যে রূপান্তর না করার অনন্য মানসিকতা। শৈশবে পিতাকে হারানো, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর প্রবাসে মৃত্যু, মায়ের দীর্ঘ কারাবাস এবং ১/১১-তে নিজের ওপর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি সদ্য পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার মতো ‘স্বজন হারানোর বেদনা’ বা ‘এতিম’ পরিচয়কে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি।
শেখ হাসিনা যেখানে আবেগের কার্ড খেলে সহানুভূতি আদায়ের রাজনীতি করেছেন, সেখানে তারেক রহমান পাহাড়সম ত্যাগ ও নির্যাতনের পরেও প্রতিশোধ বা আবেগের সস্তা প্রদর্শনী না করে রাষ্ট্র সংস্কার, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ ও আইনের শাসনের কথা বলে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন; যা তাকে সমসাময়িক রাজনীতিতে শেখ হাসিনার চেয়ে গুণগত ও আদর্শিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।
বাংলাদেশের গতানুগতিক প্রেক্ষাপটে ষাট বছর বয়সকে অনেকে বার্ধক্যের শুরু হিসেবে বিবেচনা করলেও, বিশ্ব রাজনীতির বিশাল ক্যানভাসে এই বয়সটিই একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও অভিজ্ঞতার ‘স্বর্ণালী সময়’ বা ‘গোল্ডেন এজ’। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, উইনস্টন চার্চিল ৬৫ বছর বয়সে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমান ঠিক তেমনভাবে আজ ফ্যাসিবাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে টেনে তোলার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন।
একইভাবে, দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর ৭৫ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা যে ক্ষমার রাজনীতি শিখিয়েছিলেন, তারেক রহমানের ‘প্রতিহিংসা নয়, পরিবর্তন’ স্লোগানে আজ সেই মহান আদর্শেরই প্রতিচ্ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো যেমন ৬০ পরবর্তী সময়েই হয়েছে, কিংবা রোনাল্ড রিগ্যান ও লুলা ডি সিলভার মতো নেতারা যথাক্রমে ৬৯ ও ৭৭ বছর বয়সে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সফল হয়েছেন, তেমনই দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন, নির্যাতন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তারেক রহমানকে বিশ্বনেতাদের এই কাতারে নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা; তারা মনে।করছেন, ৬০ বছর বয়স তারেক রহমানের জন্য অবসরের বার্তা নয়, বরং দেশ গড়ার প্রকৃত অর্জনের যাত্রাসুচনা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয় শীর্ষ নেতার জন্মদিন মানেই যেখানে কেক কাটা, মিষ্টি বিতরণ ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের দীর্ঘদিনের রেওয়াজ, সেখানে এবার এক ব্যতিক্রমী ও সংবেদনশীল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারেক রহমান। তিনি লন্ডন থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করেছেন যে, দেশব্যাপী তার জন্মদিনে কোনো কেক কাটা বা উৎসবমুখর কর্মসূচি পালন করা যাবে না। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আত্মদানকারী হাজারো শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ক্রান্তিকালীন বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি উৎসবের পরিবর্তে ত্যাগের পথ বেছে নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তকে তার রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও জনমানুষের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
আইনি বাধার প্রাচীর একে একে সরে গেলেও তারেক রহমান ঠিক কবে নাগাদ দেশের মাটিতে পা রাখবেন, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে তুমুল আগ্রহ ও অপেক্ষা। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ধারণা করা হয়েছিল তিনি দ্রুতই দেশে ফিরবেন, কিন্তু তিনি বরাবরের মতোই ধীরস্থির ও কৌশলগত অবস্থান বজায় রেখেছেন। যদিও উচ্চ আদালত থেকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ সবগুলো মামলাতেই তিনি খালাস পেয়েছেন এবং তার পাসপোর্ট নবায়ন সংক্রান্ত জটিলতারও সুরাহা হয়েছে, তবুও তিনি সম্ভবত আইনি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ও নিশ্ছিদ্র সমাপ্তির অপেক্ষা করছেন।
দলীয় নীতিনির্ধারকদের সূত্রে জানা গেছে, তিনি ‘পলাতক’ তকমা ঘুচিয়ে, সম্পূর্ণ আইনি বৈধতা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে দ্রুতই বীরের বেশে দেশে ফিরবেন। এদিকে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—তৃণমূলের লাখো নেতাকর্মী তাদের নেতার সশরীরে উপস্থিতির জন্য প্রহর গুনছে। ভার্চুয়াল নেতৃত্বের সীমানা পেরিয়ে তিনি কবে সরাসরি জনতার কাতারে দাঁড়াবেন, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় এখন পুরো বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৭ বছরের দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল একটি ব্যক্তি বা দলের ঘটনা হবে না, বরং তা হবে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির এক বিশাল বাঁক বদল।
৬০ বছর বয়সে পদার্পণ এবং দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে তারেক রহমান বর্তমানে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। এক সময় তার বিরুদ্ধে ওঠা নেতিবাচক অভিযোগ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নানামুখী চাপ মোকাবিলা করে তিনি যেভাবে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রেখেছেন, তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি কেড়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তার বক্তব্যে প্রতিহিংসার পরিবর্তে আইনের শাসনের কথা বলা এবং জন্মদিনের উৎসব বর্জন করে জনকল্যাণের নির্দেশনা দেওয়াকে বিশ্লেষকরা তার রাজনৈতিক পরিপক্কতার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন।
তবে রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের সামনের পথটি মসৃণ নয়। আইনি বাধা বিপত্তি পার হয়ে দেশে ফিরে আসা, দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ঘোষিত ‘৩১ দফা’ রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক বিয়োগান্তক ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না করে তিনি যে সংযত আচরণের পরিচয় দিয়েছেন, তা তার ভাবমূর্তিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দেশবাসী এখন দেখার অপেক্ষায় রয়েছে- দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক সময়ের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক কৌশল কাজে লাগিয়ে তিনি আগামী দিনের বাংলাদেশকে কোন পথে ধাবিত করেন।