স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১৭:৫১ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৮ বার
নীলফামারীর এক ভ্যাপসা গরমের বিকেল। সময়টা করোনাকালীন, যখন মহামারিতে গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ গ্রামে কিশোরী মারুফা তখন জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত। কোনো ট্রাক্টর বা গরু নয়, নিজের রোদে পোড়া কাঁধে কাঠের জোয়াল তুলে নিয়ে তিনি চাষ করছিলেন জলমগ্ন ধানক্ষেত।
কাদা-মাটিতে দেবে যাচ্ছিল পা, তবুও কর্তব্যের টানে থামেননি তিনি। সেই সময় ক্রিকেট ছিল তার কাছে শুধুই এক অলীক স্বপ্ন, যা দিনের কাজ শেষে ভাইদের সঙ্গে বাড়ির দেয়ালে বল ছুঁড়ে মেটাতেন।
মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে সেই মেয়েটিই, মারুফা আক্তার, দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামে। বুকে বাংলাদেশের লোগো, আর গ্যালারিজুড়ে তার নামের স্লোগান। নীলফামারীর ধানক্ষেত থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের এই যাত্রাপথটি যেন এক অদম্য সাহসের রূপকথা।
২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম মারুফার। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবার সঙ্গে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করেছেন, মা সামলেছেন সংসারের কাজ। করোনার সময় যখন স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, মারুফা বাবার সঙ্গে লাঙল দেওয়ায় যোগ দেন। তিনি বলেন, “পরদিন কী খাব, তা আমরা জানতাম না। তবুও আমি সময় বের করে বোলিং প্র্যাকটিস করতাম, হোক তা দেয়ালের বিরুদ্ধে।”
ভাইদের উৎসাহে ক্রিকেট শুরু করলেও গ্রামের মানুষের টিপ্পনী কম সইতে হয়নি তাকে। ছেলেদের সঙ্গে মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলছেন—এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। বাবাও চিন্তিত ছিলেন লোকলজ্জার ভয়ে। কিন্তু মারুফা মাকে কথা দিয়েছিলেন, “মা, তুমি কারো কথা শুনো না। আমি ঘরের কাজ শেষ করেই খেলব।”
মারুফার শৈশবের কোচ লিখন ইসলাম জানান, “মারুফা যখন প্রথম মাঠে আসে, তার গতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ফিল্ডিংয়ে সে ছেলেদের চেয়েও চনমনে ছিল।” শুরুতে তার নিজস্ব কোনো ক্রিকেট কিট ছিল না। কোচের সরঞ্জাম ধার করেই অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেট শুরু করেন তিনি।
কোচ লিখনই তার প্রতিভার কদর বুঝে তাকে বিকেএসপিতে ট্রায়াল দেওয়ার পরামর্শ দেন। জেলা শহর ছেড়ে ঢাকায় আসাটা ছিল তার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। তবে বিকেএসপিতে তার বোলিং অ্যাকশন আরও ধারালো হয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে ১২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলার পর অনূর্ধ্ব-১৯ এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাক পান তিনি।
সদ্য সমাপ্ত আইসিসি নারী বিশ্বকাপে মারুফা নিজের জাত চিনিয়েছেন। তার সাবলীল রান-আপ এবং ন্যাচারাল আউটসুইং দেখে শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “বাংলাদেশ একটি রত্ন খুঁজে পেয়েছে। মারুফার রিদম এবং নিয়ন্ত্রণ ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য খাঁটি সোনা।” বাংলাদেশ অধিনায়ক নিগার সুলতানার মতে, মারুফা দলে নতুন বিশ্বাসের সঞ্চার করেছেন।
তবে এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে কঠিন বাস্তবতা। ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনি জানান, গ্রামের মেয়েদের জন্য ব্যাট ধরাটাই এক ধরণের বিদ্রোহ। জাতীয় দলে আসার আগেই তাদের হাজারো অদৃশ্য লড়াই জিততে হয়। এছাড়া নারী ক্রিকেটারদের বেতন বৈষম্য ও সুযোগ-সুবিধার অভাব এখনো প্রকট। যেখানে পুরুষ ক্রিকেটাররা বিপুল অর্থ পান, সেখানে সেরা নারী ক্রিকেটারদের মাসিক আয় ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারের (১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তবুও পরিবর্তন আসছে। নীলফামারীতে মারুফার বাড়ির পাশে স্থানীয়রা সিমেন্ট দিয়ে একটি পিচ তৈরি করে দিয়েছেন, যার নাম এখন ‘মারুফার মাঠ’। সেখানে প্রতিদিন বিকেলে শিশুরা জড়ো হয় ক্রিকেট খেলার স্বপ্নে।
যে মেয়েটি একদিন দিগন্তের ওপারে স্বপ্ন দেখতে ভয় পেত, আজ সে হাজারো কিশোরীর অনুপ্রেরণা। মারুফার সহজ বার্তা, “অন্যের কথায় কান দিও না। নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাও। ক্রিকেট আমাকে কথা বলার শক্তি দিয়েছে। আমি চাই আমার মতো গ্রামের প্রতিটি মেয়ে বিশ্বাস করুক—তারাও সব জয় করতে পারে।”