ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১৯:৪২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৮ বার
পৃথিবীতে সত্য বলার স্বাধীনতা সবচেয়ে সুন্দর ও শোভন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে এ স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কী পারে তার জীবনের সব সত্যকে প্রকাশ করতে? সব মানুষের জীবনেই এমন কিছু কথা থাকে যা সে কারো কাছেই প্রকাশ করতে পারে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বন্ধু—বান্ধব, আত্মীয়—স্বজন, পরম প্রিয়জন থাকা সত্ত্বেও মানুষ তার জীবনের অনেক সত্যকে প্রকাশ করার মত মানুষ খুঁজে পায় না। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন। সব থাকতেও মাঝে মাঝে সে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে করে। জীবনের গোপন কথাটি বলার জন্য কাউকে খুঁজে না পেলে সে নিজেকে বড় একা এবং অসহায় ভাবে। এই—অসহায়ত্ব সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি আছে। তবে গভীর জীবনবোধ সম্পনড়ব মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব বেশি।
দেখা যায়, জীবনবোধ যতো গভীর, অসহায়ত্ব ততো বেশি। গভীর জীবনবোধ সম্পনড়ব মানুষ এমন অনেক কিছুই করতে পারে না, যা সাধারণে অনায়াসেই পারে। অভিজ্ঞতা এবং চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব জাগিয়ে তোলে। এজন্য একজন সত্যিকারের পণ্ডিত তার নামের আগে পণ্ডিত শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন না। সত্যিকারের কোনো দার্শনিক নিজের নামের সঙ্গে দার্শনিক শব্দটি জুড়ে দেন না। সত্যিকারের কোনো বিজ্ঞানী নিজেকে বিজ্ঞানী হিসেবে জাহির করেন না। কারণ, সৃষ্টি কিংবা রহস্যকে আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন তার সীমাবদ্ধতা কত বেশি।
একজন হাতুড়ে ডাক্তার তার রোগীকে খুব সহজেই পাওয়ারফুল একটি ওষুধ খাইয়ে দিতে পারেন। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তা পারেন না। তাকে একটি ওষুধ দিতে হলে বেশ ভাবতে হয়, পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে আসল রোগটিকে খুঁজে বের করতে হয়। ফরাসি চিত্রশিল্পী পল গগাঁ আধুনিক সমাজকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন।
১৮৯১ সালে সুইডিশ নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা সভ্যতাই যা তোমাদের ভোগাচ্ছে। বর্বরতার মধ্যেই আমি আমার জীবনকে পুনঃনির্মাণ করতে চাই।’গগাঁ ছিলেন খুব দারিদ্র্যপীড়িত একজন মানুষ। আধুনিক সমাজের চোখে যারা বর্বর ও নিচু তিনি কেবল সেই স্তরের জনগণের সঙ্গেই মিশতেন এবং তাদের জীবযাত্রা নিয়ে ছবি আঁকতেন। সেই ছবিগুলোই এখন খুব চড়া দামে বিক্রি হয়। আধুনিক সমাজের সদস্যরাই তা কিনে মনে মনে ধন্য হয়। ঘৃণার ভাষা বোঝার মত বোধজ্ঞানটুকুও তাদের নেই। ছবি এঁকে এবং কথিত আধুনিক সমাজ থেকে দূরে গিয়েও গগাঁ কি পেরেছেন তাঁর জীবনের সব সত্যকে প্রকাশ করতে? ‘এটা সভ্যতাই যা তোমাদের ভোগাচ্ছে’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? কথাটিতো তিনি অন্যভাবেও প্রকাশ করতে পারতেন যাতে আধুনিক সমাজ তার ভাষা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সেভাবে তিনি বলেন নি। এখানেই সত্যিকারের সভ্য মানুষের সঙ্গে কথিত সভ্য মানুষের তফাৎ। সাধারণে সত্যকে যেভাবে প্রকাশ করতে পারেন, বড় মানুষরা সেভাবে পারেন না। আমাদের দেশের চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, সারা বিশ্বের শিল্পরসিকরা যাকে এক নামে চিনতেন—জানতেন, সেই মানুষটি স্বদেশে ফিরে বাকি জীবনটি কেন কাটিয়ে দিলেন কথিত আধুনিক সমাজ থেকে বহু দূরে অজপাড়াগাঁয়ে? তাঁর মৃত্যুর পর অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, নাগরিক শিল্পীরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে অনেক দামি দামি কথা বলেছেন অথচ কেউ কি পেরেছেন তাঁর জীবনের চরম সত্যকে উদঘাটন করতে? আজ যে মানুষটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিয়ে অথবা সে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে মনে মনে জাতে ওঠেন, সেই মানুষটি অথবা তারই মতো কেউ হয়তো একদিন এই নজরুলকে ভয়ানক দারিদে্র্যর চক্রে ঘুরপাক খেতে দেখেও না দেখার ভান করেছেন কিংবা চক্ষু ও ওষ্ঠযুগল বাঁকিয়ে উপহাস করেছেন। ভাবলে হাসি পায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, কম্যুনিষ্ট, আস্তিক, নাস্তিক, দুর্নীতিবাজ সকলেই আজ নজরুলকে একান্ত নিজের বলে দাবি করেন। এমন কি তাঁকে শীর্ষে স্থান দেয়ার জন্য তর্ক—বিতর্ক, হাতাহাতি করতেও পিছ পা হন না। কী জানি, হয়তো এ ধরনের ‘ভদ্রতা’ দেখানোর কারণেই পল গগাঁ, এস এম সুলতান প্রমুখ কথিত আধুনিক সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। ভোগ—বিলাসের মোহে কখনো তারা অসত্যকে মেনে নেননি। নিয়তির নির্মম সত্য হচ্ছে, গগাঁ, নজরুল, সুলতান, কিংবা সুকান্তের মতো মানুষেরা এক সময় প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠেন কথিত আধুনিকদের চোখে, অথচ যখন তাদের চেনা উচিত ছিল তখন কেউই চেনেননি। কারণ কথিত আধুনিকরা সময়ের কাজ সময়ে করতে অভ্যস্ত নন এবং জীবনের মাঠে তাদের কাছে সমাজের বাইরের চেহারাটাই বড় হয়ে ওঠে। তারা সমাজের ভেতরটাকে কখনো জানতেও চায় না, বুঝতেও চায় না। সত্যের কাছ থেকে তারা রয়ে যায় বহু দূরে। অনেকে মনেপ্রাণে রক্ষণশীল হয়েও চলনে—বলনে, পোশাকে হার মানিয়ে দিতে পারে ইউরোপীয়দের। অনেকে প্রচন্ড দাম্পত্য কলহ পুষে রেখেও ভাব দেখাতে পারে শান্তির। অনেকে মোটেও ভাল না থেকেও খুব সহজেই বলে দিতে পারে, ভাল আছি। তবে এটাও সত্য যে, সব মানুষকেই এক সময় সত্যের কাছে ফিরে আসতে হয়। মিথ্যা বা অসত্য যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, সত্য তাকে হাতছানি দেয়। সত্যের শক্তি এতো বেশি যে, নিজাম ডাকাত আউলিয়া হয়ে যান, অনেক নাস্তিক মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়েই আস্তিক হয়ে যান। সমাজে দেখা যায়, অনেকে তাদের কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে কাঙ্খিত পুরস্কার না পেয়ে আফসোস করেন। কিন্তু সব পুরস্কারে কি সত্যের প্রকাশ ঘটে? তলস্তয় নোবেল পুরষ্কার পাননি, অথচ তাকে বাদ দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের কথা ভাবাই যায় না। প্রশড়ব হচ্ছে, ‘নোবেল’ না পেয়ে কি তলস্তয় ছোট হয়ে গেছেন, নাকি নোবেলই ছোট হয়েছে? মানুষ যদি তার জীবনের সব সত্যকে প্রকাশ করতে পারতো কিংবা করতো তবে পৃথিবীটা নিশ্চয় অন্যরকম হতো। অনেক অনাকাঙ্খিত ও অশান্তিময় ঘটনা হয়তো তখন ঘটতো না। সব মানুষই খুব সহজে বুঝতে পারতো, কোনটা গর্বের, কোনটা ঘৃণার। কে জ্ঞানী, কে ভন্ড। কেউই তখন কাউকে সাত—পাঁচ বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেতো না এবং সাধারণের সরলতার সুযোগ নিয়ে পৃথিবীকে বিষাক্তময় করে তুলতে পারতো না।
লেখক : কবি
সাংবাদিক কলামিষ্ট। জীবন সদস্য, বাংলা
একাডেমি।